গল্প- মৃত্যুর ডাক

মৃত্যুর ডাক
সোম

 

কাকাবাবুর অতি কষ্টের সংসার। তিনি নিজে ঝাড়ু নিয়ে ফেরি করেন আর কাকিমা গোরুর দুধ বিক্রি করে সংসার চালান। এই অভাবের মধ্যে দিয়ে তাঁর তিন মেয়ের বিয়ের কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন করেছেন। তখনও তাঁর দুই ছেলে লেখাপড়া করছে। বড় ছেলে সঞ্জয় মাধ্যমিকে এবং ছোট ছেলে সৌমেন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ছে। ফাইনাল পরীক্ষার আর বেশি দেরি নেই, এবার ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে সে অষ্টম শ্রেণীতে পড়বে। সৌমেন ভালো করে জানতো যে, সে ছাড়া আর অন্য কেউ ফার্স্ট হতে পারবে না। কারণ পঞ্চম শ্রেণী থেকে সে ফার্স্ট হয়ে আসছে। এবারও সৌমেন ফার্স্ট অবশ্যই হবে। কিন্তু তবুও আরো ভালো করে রেজাল্ট করবার জন্য পরীক্ষার প্রস্তুতিটা একটু আগে থেকে শুরু করেছিল সৌমেন।

সেদিন ছিল তার ছোট দিদির বিয়ে।সকাল থেকে শুরু হয়েছিল সানাইয়ের সুর। সানাইয়ের মিষ্টি সুর মুগ্ধ করেছিল বাড়ির সবাইকে। বাড়িতে অনেক আত্মীয়-স্বজনের সমাগম। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের চিৎকার চেঁচামেচি ও আনন্দ ফূর্তির উল্লাস দেখে মনে হলো, এ যেন এক বিশাল আনন্দের মেলা বসেছে। কেউ কেউ কনের গায়ে তেল-হলুদ মাখানো নিয়েই ব্যস্ত ছিল। আবার কেউ বরণডালা সাজাবার কাজে ব্যস্ত। রান্নার শাল থেকে গলগল করে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উড়তে আরম্ভ করেছে, দেখে মনে হলো –রান্নার ঠাকুর রান্নার কাজটা শুরু করে দিয়েছেন। এদিকে আবার প্যান্ডেলের লোকজন বর আসন তৈরী করে দিয়ে, খাওয়ার প্যান্ডেলে সুন্দর করে কাপড় লাগাচ্ছেন।আমি তখন ফুল দিয়ে সুন্দর করে বর আসন সাজাচ্ছিলাম। কাকাবাবু ও কাকিমা বাড়ির অন্য কাজে নিযুক্ত ছিলেন। তাই কেউ তখন খোঁজ রাখলেন না সৌমেনের। সে তখন একা একা পড়ার ঘরে বসে অবিরাম বইয়ের সাথে লড়াই করে চলেছে। ছোট দিদির বিয়ে বলে কথা! কিন্তু সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ মাত্র নেই। তার পড়াশোনায় এতো আগ্রহ যে, দিদির বিয়ের দিন পর্যন্ত বন্ধ রাখলো না তার প্রতিদিনের অনুশীলন l
দেখতে দেখতে সূর্য্য রক্তিম হয়ে, ধীরে ধীরে মেঘের সাথে বন্ধুত্ব করে পশ্চিম আকাশে ডুবে গেল। তারপর কয়েক মুহূর্তেই চারিদিক থেকে ঘন-অন্ধকারে গ্রামটাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ঢেকে দিল।
তারপর কিছুক্ষণের মধ্যে জেনারেটরের আলোয় ঝলমল করে উঠল বিয়ে বাড়ি। ইতিমধ্যে শোনা গেল বর এসে গেছে। বাড়ির সবাইয়ের মধ্যে কেমন একটা তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। শঙ্খের ধ্বনিতে ও উলুর ধ্বনিতে আমার হৃদয়টা আনন্দে নেচে উঠল। হঠাৎ সেই সময় মনে পড়ে গেল সৌমেনের কথা। আমি তখন দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললাম, তার পড়ার ঘরের দিকে। যেতে-যেতে দেখতে পেলাম, সৌমেন এই মাত্র ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদনাতলার দিকে আসছে। আমাকে দেখামাত্রই সে হাসতে হাসতে বলল, দাদা তু্ই এখানে, চল দেখবি চল l ছোট দিদির বর এসেছে!
আমি আনন্দে বললাম, বর কেমন দেখতে রে?
সঞ্জয় আসে বলল, খুব সুন্দর দেখতে। তুই এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস ছোটদা? চল, বাবা তোকে ডাকছে।
আমি সেখান থেকে প্রস্থান করে কাকাবাবুর আদেশ অনুসারে বর যাত্রীদের খাওয়াবার ব্যবস্থা করতে আরম্ভ করলাম।

ছোট বড় সব ছেলে মেয়েরা বরকে ফুল মারছে আর হাসি-ঠাট্টা ও আনন্দে ফুর্তিতে মেতে উঠেছে। সৌমেন একপাশে একখানি চেয়ারের উপর বসে, সেই দৃশ্যখানি দেখতে দেখতে আনন্দ উপভোগ করছিল। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ সে চেয়ার ছেড়ে উঠে মাথার দু’পাশে জোরে হাত চেপে ধরে মায়ের কাছে ছুটে এসে বললো-মাগো, আমার ভীষণ মাথার যন্ত্রণা করছে!
মা কোন কিছু না ভেবে বললেন– সারাদিন এক জায়গায় বসে পড়ছিলিস, তাই হয়তো অমন হচ্ছে। আজ তোর ছোট দিদির বিয়ে, সবাই আনন্দ করছে! যা- তুইও গিয়ে ওদের সঙ্গে আনন্দ কর, দেখবি কিছুক্ষণ পর মাথার যন্ত্রণা ভালো হয়ে যাবে। এই বলে তিনি ঘরের ভিতরে চলে গেলেন।

সৌমেন সপ্তম শ্রেণীতে পড়লে কি হবে, বয়সের দিক দিয়ে বেশ অনেকখানি ছোট ছিল। তাই সে মায়ের কথায় কোন প্রশ্ন না করে, ভাবলো মা যা বলেছেন তা হয়তো বা ঠিক। তারপর বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল, আবার শুরু হলো সৌমেনের মাথার যন্ত্রণা। এবার সে আর সহ্য করতে না পেরে, শেষটায় বাপের কাছে কেঁদে পড়লো। সৌমেন ছিল কাকাবাবুর চোখের মণি। তাই তার কিছু হলে, তিনি সহ্য করতে পারতেন না। ছেলের কান্না দেখে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন- কি হয়েছে, মাথার যন্ত্রণা করছে? কখন থেকে শুরু হয়েছে?
এইরকম নানা প্রশ্ন করতে করতে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে তাড়াতাড়ি ডাক্তারখানায় আসলেন। ডাক্তারবাবু সব কিছু শোনার পর আর একটুও সময় নষ্ট না করে সৌমেনকে কয়েকটা ট্যাবলেট খাইয়ে দিলেন। কিন্তু তাতে কিছুমাত্র যন্ত্রণা কমলো না। তাই ডাক্তারবাবু সেই রাত্রিটা ওকে ডাক্তারখানায় রাখার ব্যবস্থা করলেন।

একদিকে মেয়ের বিয়ের আনন্দ আর অন্য দিকে ছেলের মাথার যন্ত্রণা। এই দুই দিকের টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে ভোলানাথ বাবুর কোনো রকমে দুঃখানন্দ ভাবে রাত্রিটা কেটে গেল।

রাত্রির সেই কালো অন্ধকার এখন আর নেই। কালো অন্ধকার কেটে পূর্ব আকাশে পরিস্কার সোনার থালার মতো একখানি উজ্জ্বল সূর্য্য জ্বলজ্বল করে উদিত হলো। সূর্য্যের আলো দেখে কাকাবাবুর হৃদয় কেঁপে উঠলো, এবার বুঝি ছোট মেয়ে মধুরিমাকে তাঁর বুক থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে। সত্যি সত্যিই নববধূর সাজে বাড়ির সকলকে কাঁদিয়ে, বাপ-মায়ের ভালোবাসা ত্যাগ করে কাঁদতে কাঁদতে সে শ্বশুর বাড়িতে চলে গেল।

তারপর মাসখানেক কেটে গেল। সৌমেন তার মাথার যন্ত্রণার কথা ভুলে, আবার সে তার প্রতিদিনের রুটিন অনুযায়ী পাঠে মন দিলো। কাকাবাবু ভাবলেন তা হলে, সৌমেনের আর হয়তো মাথার যন্ত্রণা হবে না। এই ভাবে আরো দিন পনেরো কেটে গেল। সৌমেনের মাথার যন্ত্রণার কথা কারো মনে রইলো না।

একদিন ক্লাসের মধ্যে তার ভীষণ ভাবে মাথার যন্ত্রণা শুরু হলো। সে তখন বেঞ্চের উপর পড়ে ছটফট করতে লাগলো। কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী অফিস রুমে হেড মাস্টার মশাইকে খবরটা জানালো। মাস্টার মশাইরা ও ছাত্র-ছাত্রীরা ধরাধরি করে ডাক্তার খানায় নিয়ে আসলো সৌমেনকে। কাকাবাবু ও কাকিমা খবর পেয়ে একেবারে পাগলের মতো অবস্থায় দ্রুত ছুটে আসলেন ডাক্তারখানায়। প্রথমে ছেলেকে দেখে কাকাবাবু ও কাকিমা হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন, কিন্তু সৌমেন বাপের কান্না সহ্য করতে পারে না। তাই সে বাপকে সান্ত্বনা দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বললো- বাবা এই দ্যাখো, আমি বেশ ভালো আছি ! তুমি কাঁদছো কেন?
কাকাবাবু সৌমেনের কথার কোন উত্তর না দিয়ে, তাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন।

এই ভাবে আরো বেশ কিছুদিন কেটে গেল। কিন্তু সৌমেনের মাথার যন্ত্রণা কোন ডাক্তার কমাতে পারলেন না। তার যন্ত্রণা কেবল বেড়ে চলেছে, অবশেষে কাকাবাবু ছেলের এই অসহ্য যন্ত্রণা আর সহ্য করতে না পেরে কোলকাতায় একটি বড়ো সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করলেন। কিন্তু সেখানে তিনি কোনো সুফল না পেয়ে, সেই হাসপাতাল থেকে নিয়ে আবার একটি নার্সিং হোমে ভর্তি করলেন। সেখানে সৌমেনের ব্রেনের সমস্ত রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর রিপোর্ট পেলেন যে, তার ব্রেন ক্যান্সার হয়েছে। ডাক্তারবাবু সৌমেনের সামনে কিছু না বলে, কাকাবাবুকে ডেকে ঘরের বাইরে নিয়ে গেলেন এবং সান্ত্বনা দিয়ে বললেন- ভোলানাথ বাবু আপনি চিন্তা করবেন না, আপনার ছেলে ভালো হয়ে যাবে। তবে কিন্তু প্রচুর টাকার দরকার।
– কত টাকা?
– তা ধরুন প্রায় পঞ্চাশ হাজার!
– পঞ্চাশ হাজার টাকা!
– হ্যাঁ, পঞ্চাশ হাজার টাকা! তাতেও ভালো নাও হতে পারে!
কাকাবাবু কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, কি হয়েছে আমার সৌমেনের?
ডাক্তার একটু মাথা নিচু করে বললেন, আপনার ছেলের ব্রেন ক্যান্সার হয়েছে!
এই কথা শোনামাত্র কাকাবাবু আতঙ্কে ছুটে ঘরের ভিতরে এসে ছেলের বিছানার পায়ের কাছে হতবুদ্ধির মতো চুপচাপ অচৈতন্য অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আর তাঁর দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে চোয়াল বেয়ে !

তিনি ছেলেকে নিয়ে বুকে গভীর আশা বেঁধে ছিলেন, ছেলে বড়ো হয়ে মানুষের মতো মানুষ হলে, তাঁর সমস্ত দুঃখ-কষ্ট মুছে যাবে। তিনি মনে মনে আরও ভেবেছিলেন, ছেলে একজন মস্ত বড়ো ডাক্তার হয়ে গরীব গ্রামবাসীদের পাশে এসে দাঁড়াবে। আর গ্রামবাসীগণ তাঁকে দেখে বলবে ডাক্তার সৌমেনের বাবা ভোলানাথ বাবু। তখন তাঁর বুকটা গর্বে ভরে উঠবে। কিন্তু ভগবানের নিষ্ঠুর বিচারের ফলে তাঁর সেই আশা আকাঙ্ক্ষা চিরদিনের জন্যে শেষ হয়ে গেল।

সৌমেন বাপের হাত চেপে ধরে বললো, বাবা তুমি অমন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ডাক্তারবাবু কি বলেছেন? তাহলে কি আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না?
এই রকম কঠিন কঠিন প্রশ্ন করতে থাকে। কাকাবাবু এতক্ষণে চৈতন্য ফিরে পেয়ে, বললেন, তুই খুব তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাবি! হ্যাঁ রে সৌমেন তুই ভালো হয়ে যাবি!
এই বলে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন। তিনি ভাবলেন ছেলে হয়তো বুঝতে পারলো না যে, তার এতো বড়ো একটা মৃত্যু সম্মুখীন রোগ হয়েছে। বাপ সৌমেনকে তার রোগের কথা বলেনি ঠিক কথা, কিন্তু তাঁর চোখের জল পরিস্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন, সে আর বেশি দিন বাঁচবে না!

এই বৃহৎ পৃথিবীতে আলো বাতাস, মা-বাবার ভালোবাসা ছেড়ে কিছুতেই মরতে ইচ্ছা করলো না তার। কিন্তু কিছু করার উপায় নেই। জন্মালে মরতে হবে, এই কঠিন চিরসত্য কথাটি অতি সহজে মেনে নিলো।

সময় আর কিছুতে কাটতে চায় না। তাই সৌমেন একখানি খাতা আর পেন নিয়ে একটি কবিতা লিখলো। সে তার কবিতার মাধ্যমে প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকে বোঝাতে চেয়েছে, শুধু লেখাপড়া নয়, আন্তরিক ভালোবাসার দ্বারা এই পৃথিবীর সব কিছুকে জয় করা যায়। তাই সৌমেন কবিতার নাম করণ করলো “লেখাপড়া”।
লিখতে হবে পড়তে হবে,
লেখাপড়া শিখতে হবে ভাইরে।
লেখাপড়া বিনা উচ্চ-সম্মান
বিশ্ব মাঝে আর কিছুতে নাইরে।
খেলবো আমি নানান খেলা,
দেখবো টিভি পড়ার ফাঁকে।
গান গেয়ে আবৃত্তিতে —
হারিয়ে দেবো অন্য সব্বাইকে।
চুপটি করে থাকবো নাতো,
পড়বো জোরে জোরে।
লেখাপড়া শিখলে তবে,
বাসবে ভালো মোরে।
সবার সেরা সবার ভালো,
হবো আমি যেন !
প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় আমি
হবো না কক্ষনো !

এই কবিতাখানা পড়ে আনন্দে কাকাবাবুর হৃদয় কেঁদে উঠলো। তাঁর এতো দিনের স্বপ্ন বুঝি এবার শেষ হয়ে যাবে। তিনি ভালো করে জানতেন, একবার যদি কারো ক্যান্সার হয়, তাহলে সহজে তাকে ভালো করা যায় না। কিন্তু তিনি নিজের মনকে কোন ভাবে সান্ত্বনা দিতে পারলো না। তাই তিনি তাঁর শেষ সম্বল গরুটিকে বিক্রি করে এবং অতি সুদে হাজার কুড়ি টাকা জোগাড় করে আনলেন, ছেলেকে ভালো করবার জন্য।

এদিকে তখন সৌমেন মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। কাকাবাবুকে সে ক্ষীণ গলায় বললো– বাবা, তুমি আর আমার জন্য টাকা ব্যয় করো না। আমি তোমার সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষা শেষ করে, তোমাকে পথে বসিয়ে চলে যাচ্ছি। মৃত্যু আমাকে বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকছে ! এবার তোমার কোলের উপর আমার মাথাটা রেখে আমি শান্তভাবে মরতে চাই বাবা ! মৃত্যু আমাকে ডাকে…………

কাকাবাবু আকাশ ফাটা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন– আমার সব শেষ হয়ে যাক, তবুও আমি তোকে বাঁচাবো রে সৌমেন! আমি তোকে বাঁচাবো!
ডাক্তার- নার্স সবাই ছুটে আসে, ততক্ষণে সৌমেন, বাবা-মা ও এই পৃথিবীর সবাইকে ছেড়ে সে মৃত্যুর পথযাত্রী হয়ে চলে গেছেন— স্বর্গপূরীতে !

-সমাপ্ত-

Loading

Leave A Comment